ভাবির ভাইরাল ভিডিও দেখুন।

ভিডিও লিংক


 


অফিস শেষে বের হয়ে রাস্তার উল্টা দিকের ল্যাম্পপোস্টে আমার চোখ আটকে গেলো। আবির যেখানে সাধারণত দাঁড়িয়ে থাকে সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে এক মহিলা। দেখেই বুঝা যাচ্ছে যে সে বাংলাদেশি। তার দৃষ্টি আমার দিকে নিবদ্ধ। আমার বুকের হৃদস্পন্দন ছাড়া আর আশেপাশের কিছুই যেন শুনতে পাচ্ছিলাম না আমি। তারপরও যথাসম্ভব মুখে একটা সপ্রতিভ ভাব ফুটিয়ে রেখে তার দিকে এগিয়ে গেলাম। খুবই মিষ্টি দেখতে সামান্য নাদুস নুদুস এক মহিলা দাঁড়িয়ে আছে। পরনে একটা জিন্স আর মনে হয় আড়ংয়ের এক সাধারণ ফতুয়া। বয়স আমার মতোই হবে, এই মধ্য তিরিশের এদিক ওদিক। আমি আবিরের কাছে তার স্ত্রীর কথা শুনে শুনে নিজের অজান্তেই মনের মধ্যে তার একটা ছবি দাঁড় করিয়েছিলাম। সেই ছবির সাথে এর কোনো মিল নেই। এ কী সত্যি সত্যিই আবিরের ওয়াইফ? এই প্রথম আবিরের স্ত্রী আর পরিবার সম্পর্কে খবর না নিয়ে আবিরের সাথে সম্পর্ক করার জন্য বুকের ভিতর একটু খচ খচ করছে নাকি?  
সেই কথা শুরু করলো। কথার মধ্যে কোনো ভনিতা বা জড়তা নেই। বললো,
 - আমি অদিতি। আবিরের ওয়াইফ। আর আপনাকে তো আমি চিনিই। আমরা কি কোথাও বসে একটু কথা বলতে পারি?
- আপনি যে আবিরের ওয়াইফ তার প্রমান কী?
- আপনাকে তো প্রমান দিতে আসিনি আমি? আপনি আমার কথা বিশ্বাস করলে করবেন, না করলে না করবেন। সেটা আপনার ব্যাপার। আমি কয়েকটা কথা আপনাকে জানাতে এসেছি। তা জানিয়েই আমি চলে যাবো।
আমি তার কথার ঝাঁঝে হকচকিয়ে গেলাম। আবিরের কথা শুনে ধারণা করেছিলাম যে তার স্ত্রী একজন ব্যক্তিত্বহীন মহিলা। দুই লাইন কথা কারও সাথে বলে উঠতে পারেনা। এই মহিলাকে তো মোটেও সেইরকম কিছু মনে হচ্ছেনা। তারপরও এই মহিলা যে আসলেই আবিরের স্ত্রী সে ব্যাপারে আমি কেন জানি নিঃসন্দেহ। তাছাড়া আমার কৌতুহলী মন। যেই কৌতূহলী মনের কারণে আমি আবিরের কথা শুনতে রাজি হয়ে গিয়েছিলাম, সেই কৌতূহলের কারণেই আমি মনেহয় আবিরের স্ত্রীর কথা শুনার আগ্রহ বোধ করছি। আমি বললাম,
- চলেন স্টেশনের ভিতরের একটা কফি শপে বসা যাক।
কফি শপে গিয়ে দুইজনই দুইকাপ চা নিয়ে বসে পড়লাম। এবারও সেই কথা শুরু করলো,
- বাচ্চাদের এক ফ্রেন্ডের কাছে রেখে এসেছি। আমাকে তাড়াতাড়ি ফিরতে হবে। আমার হাসবেন্ড কাকে দেখে এত মজলো তাকে কাছ থেকে দেখার লোভ সামলাতে পারলামনা।  
এইধরণের কথা শুনে এবার আমার একটু মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু আমি তা প্রকাশ হতে দিলাম না। বললাম,
- আবির জানে যে আপনি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন?
- নাহ, তাকে জানানোর প্রয়োজন মনে করিনি। 
- বাহ্। আপনার স্বামী আরেকজনের সাথে প্রেম করে বেড়াচ্ছে। আপনি তাকে বাড়িতে দিনের পর দিন খাতির করে রেখে তার প্রেমিকার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে এসেছেন। হাউ টিপিক্যাল। 
- আপনার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা চাইতে এসেছি আপনাকে সেটা কে বললো? আপনার মতো চরিত্রের মহিলার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা কেন, কথা বলতেও আমার রুচিতে বাঁধে। 
- নাহ, আপনার রুচির প্রশংসা না করে আমি কিন্তু পারছিনা। নিজের তো কিছু করার মুরোদ নেই আপনার। স্বামী অন্যের সাথে প্রেম করছে জেনেও তার পা আঁকড়ে ধরে পড়ে আছেন। আর আমার সাথে কথা বলতে আপনার রুচিতে বাঁধে। সত্যি কথা বলতে কী, আপনার মতো আত্মসম্মান বোধহীন মহিলার সাথে কথা বলতে আমার এখন রুচিতে বাঁধছে। 
সে আমার দিকে তাকিয়ে একটা হাসি দিলো। সেই হাসিতে এমন কিছু ছিল যে আমার নিজের আত্মবিশ্বাসের ভীত একেবারে চুরচুর হয়ে গেলো। সে বলল, 
- আমাদের দুইজনের কথা বলতেই রুচিতে বাঁধছে দেখি। তবে আপনার সাথে কথা কাটাকাটি করতে আমি আসিনি। আর আপনাকে যদি জানাতে হয় যে আমি কেন আমার হাসবেন্ড প্রেম করছে জেনেও তার সংসার করে যাচ্ছি, তাহলে আপনার কাছ থেকেও জানতে হবে, আপনি কেন জেনেশুনে আরেকজনের হাসবেন্ডের সাথে প্রেম করছেন। আপনি নিজের বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে দেখতে পারেন যে আমি যেই কাজটা করেছি সেই ব্যাপারটা বেশি ঘৃণ্য না আপনি যা করেছেন তা বেশি ঘৃণ্য? যা হোক, আপনার জীবনদর্শন আপনার কাছে, আমার জীবনদর্শন আমার কাছে। আপনাকে শুধু জানাতে এসেছিলাম, যার সাথে প্রেম করে আপনি এত পুলকিত সে কিন্তু মহা প্রেমবাজ। আগেও প্রেম করেছে, এখনও করছে, ভবিষ্যতেও করবে। কিন্তু আপনার মতো এত মডার্ন, স্ট্রং, স্বাবলম্বী মহিলারা যখন এরকম প্রেমবাজদের কাছে নিজেদের আত্মসম্মানবোধ খুইয়ে বসে থাকে তখন দেখতে ভীষণ কুৎসিত লাগে। ভীষণ ছ্যাবলামি মনে হয়।
আমি বেশ একটু থতমত খেয়ে গেলাম। আমার সামনে বসে থাকা অদিতিকে আবারো ভালোকরে একটু দেখে নিলাম। স্নিগ্ধ একটা চেহারা, আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে সে বসে আছে। ওর ফিরে যাবার কোনো ইচ্ছা দেখা যাচ্ছেনা। এবার আমি কথা বললাম,
- আপনি কি শুধু আমাকে এটা জানাতেই এখানে এসেছেন? আর আপনি কি ভেবেছেন আপনার এই মুখের কথা শুনেই আমি সব খুশি মনে মেনে নিয়ে আবিরকে একজন ধোঁকাবাজ আর প্রেমবাজ মনেকরে দূর করে দিবো। আপনার যেমন তার সম্পর্কে কথা বলার আছে, তারও কিন্তু আপনার সম্পর্কে অনেক কথা বলার আছে। 
- তা তো বটেই। তার নিশ্চয়ই আমার সম্পর্কে অনেক কথা বলার আছে। 
কিছুক্ষনের নীরবতা। অদিতিকে কি একটু হতাশ দেখাচ্ছে? আমি মেয়েটিকে বুঝার চেষ্টা করছি। কী চায় মেয়েটি? এসব কথা বলে ওর স্বামীকে ফিরে পেতে চায়? আমি কী বলবো চিন্তা করছিলাম কিন্তু সেই আবার কথা বলে উঠলো,
- আমি আপনাকে আমার কথা বিশ্বাস করতে বলছিনা। শুধু যেটুকু আপনাকে জানানোর দরকার মনে করেছিলাম, সেটুকু আপনাকে জানিয়ে দিলাম। আপনি কী করবেন সেটা আপনার উপর। তবে আপনি সময় নিতে পারেন, আবিরের সম্পর্কে খবর নিয়ে দেখতে পারেন। আর আমিও অনেকদিন সময় নিয়েছি। নিজেকে কষ্ট করে ধীরে ধীরে স্বাবলম্বী করে তৈরি করেছি। ব্যাপারটা সহজ ছিলোনা। অনেক কঠিন। শুধু আর্থিক এবং শারীরিক ভাবে কঠিন না, মানসিক ভাবেও কঠিন। আবির ভেবেছিলো আমার মতো মেয়েদের কোথাও যাবার জায়গা নেই। ওর সংসারেই আমার আজীবন পড়ে থাকতে হবে। কিন্তু সময় এসেছে ওকে ভ্রান্ত প্রমাণিত করার। আমি এখন তৈরী, আমি ওর সংসার ছেড়ে চলে যাচ্ছি। 
- বাহ্, তাহলে তো বেশ ভালোই। আপনি সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আপনার জন্য অনেক শুভকামনা। 
- থ্যাংক ইউ। আর আপনি যদি ভেবে থাকেন যে আমি ওকে ছেড়ে দিলে ও আপনার সাথে সুখে শান্তিতে বসবাস করা শুরু করে দিবে তাহলে আপনার ধারণাটা কিন্তু ভুল । ওর বাড়িতে প্রয়োজন একজন সুচারু গৃহিনী আর বাহিরে প্রয়োজন কেতাদুরস্ত আধুনিকা। 
- আমি কিন্তু কিছুই ভাবছিনা। শুধু আপনার কথা শুনছি। আপনাকে ধন্যবাদ যে আপনি আপনার জীবনের কঠিন সময়েও আমার কথা চিন্তা করে আমাকে এতগুলো উপদেশ দিতে এসেছেন। 
অদিতির ঠোঁটে আবারো সেই বুক হিম করা হাসি। ও বললো,
- আপনি সার্কাস্টিক হচ্ছেন? দুঃখের ব্যাপার কী জানেন? আমি যেমন আপনাকে দোষী ভাবছি এবং আপনি যেমন আমাকে দোষী ভাবছেন, পুরো সমাজও ঠিক একইভাবে বিভক্ত হয়ে আমাদের এই কাহিনী নিয়ে কাদা ছোড়াছুড়ি করবে। একদল আমাকে ব্যক্তিত্বহীন স্ত্রী বলে যা তা বলবে। আর আরেকদল আপনাকে নষ্ট মেয়েছেলে বলে আখ্যায়িত করে। দুই সন্তান নিয়ে এই সংসারে আমার কী অপারগতা ছিল তা আমিই জানি আর আপনি কিসের টোপে ধরা দিয়েছেন তা আপনিই জানেন। কিন্তু যেই মানুষগুলো আমার বা আপনার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে একজনকে মায়াজালে বেঁধে রাখে, পরিকল্পনা করে ছলনা করে সেই মানুষগুলো বহাল তবিয়তে কিন্তু বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়। তাদের কোনো দোষ হয়না। 
একটু থেমে অদিতি আবার বলে উঠলো, 
- আমার এখন উঠতে হবে। বাচ্চাদের এক বান্ধবীর কাছে রেখে এসেছি। সেখান থেকে ওদের উঠিয়ে আমার নতুন জীবন শুরু করবো। আমি আর আমার দুই সন্তান নিয়ে নতুন জীবন। আমি জানি, সেই জীবন মোটেও সহজ হবেনা। হয়তোবা মোটেও আনন্দের হবেনা। কিন্তু আশাকরি অনেক সম্মানের হবে। অসম্মানের জীবন কিন্তু ভীষণ কষ্টের। আর আপনাকে এতকিছু জানালাম কেন জানেন? আমার মনেহয় আপনিও আমার মতো এমন মায়াজালে আটকে পড়ে গিয়েছেন যে ভালোমন্দ বুঝার ক্ষমতা আপনার লোপ পেয়েছে। আমি জানি এই মায়াজাল, এই ধোঁকার আকর্ষণ কী সাংঘাতিক। তবে এই ধোঁকার জীবনে আর যাই থাকুক না কেন, কোনো সম্মান নাই। হয়তোবা একসময় আপনি আমার কথা উপলব্ধি করতে পারবেন। ভালো থাকবেন। চলি কেমন।
এই বলে অদিতি নামের মেয়েটি চলে গেলো। আমি স্তব্ধ হয়ে ওর চলে যাবার দিকে তাকিয়ে থাকলাম। যতক্ষণ না পর্যন্ত ও দৃষ্টির বাইরে হারিয়ে গেলো। হঠাৎ খুব ক্লান্ত লাগা শুরু করলো, নিজেকে পরাজিত এক মানুষ মনে হচ্ছে। মেয়েটি যদি আমাকে গালাগালি করে, আমার সাথে রাগারাগি করে যেত, তাহলে হয়তোবা এরকম মনে হতোনা। 
নিজের অজান্তে হঠাৎ করেই গত ছয়মাসের সম্পর্কের নানান ঘটনা আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলো। আবির যে একজন অসাধারণ গল্পকার এ ব্যাপারে আমার কোনোই সন্দেহ নেই। কথার মোহেই আমি ওর প্রেমে পড়েছি। শুধু কী কথা? ঐযে অদিতি বলে গেলো, "মায়াজাল"। কী এক মায়াজালে আমি আটকে গেছি যে আসলেই ভালোমন্দ বুঝার ক্ষমতা যেন হারিয়ে ফেলেছি।  
হয়তোবা অদিতিই ঠিক, আবির এক মহা প্রেমবাজ। স্ত্রী খারাপ, প্রেম-ভালোবাসাহীন দাম্পত্য সম্পর্ক এসব হয়তোবা ওর প্রেমের এক কৌশল মাত্র। কিন্তু ও প্রেমবাজ কি প্রেমবাজ না সেই ব্যাপারটা আমার কাছে আর মুখ্য না। ওর যে স্ত্রী আছে সেই ব্যাপারটা তো আমার ঠিকই জানা ছিল। আমি তো সেই ব্যাপারটা জেনেই ওর সাথে সম্পর্ক করেছি।
আর হয়তোবা আবিরের কথাও ঠিক। ওর স্ত্রীর সাথে দিনের পর দিন ধরে হয়তো ঠান্ডা সম্পর্ক, ওদের হয়তো যোজন যোজন ব্যবধান। তারপরও তো ওর স্ত্রী, তার সাথে সংসার করে চলছে। এতই যখন কষ্ট তাহলে সেই সংসার ছেড়ে আসার কোনো চেষ্টা করেনি কেন? সন্তানদের জন্য যখন এত মায়া, তাদের ব্যবস্থা করেই নাহয় বেরিয়ে আসতো।
আর আমি? আমি নাকি এক মহা নীতিবান মানুষ। বুক ফুলিয়ে বলেছি যে দুই নৌকায় পা দিয়ে চলা মানুষদের আমি ঘৃণা করি। এই আট বছরের আমার সিঙ্গেল জীবনে আমি তো কাউকে ঠকাইনি। তাহলে কিসের মোহে, কিসের বশে সব নীতি, সাধারণবোধ খুইয়ে বসে আছি? আসলেই নিজেকে ভীষণ ছ্যাবলা মনে হচ্ছে।
আজ যদি অদিতি আবিরের সংসার থেকে বেরিয়ে আসার সিদ্ধান্ত না নিয়ে ঠিক এই একই কথাগুলো আমাকে বলে যেত, তাহলে ওকেই আমার দুর্বল আর ছ্যাবলা মনে হতো। আজ যদি ও এখানে এসে আমার সাথে ঝগড়া বা রাগারাগি করার চেষ্টা করতো, তাহলে আমি ঠিকই নিজের আত্মপক্ষ সমর্থন করে নানান যুক্তি দাঁড় করে ফেলতাম। কিন্তু মেয়েটা যে কিছুই করলোনা। কিছু না করেই আমাকে এভাবে পরাজিত প্রতিপন্ন করে চলে গেলো? 
আমার হঠাৎ মনে হলো যে আমি জানি আমাকে এখন কী করতে হবে। আমাকেও সম্মানের জীবন ফিরে পেতে হবে। ব্যাপারটা হয়তোবা সহজ হবেনা। এই মায়াজাল ছিন্ন করা যে বড়ই কঠিন। কিন্তু এত প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও অদিতি যখন পেরেছে, আমাকেও পারতে হবে। 
আর আবির? ওর কী হবে? আমরা দুজন ওকে ছেড়ে গেলে ওর কি কোনো চৈতন্য হবে? ও কি বেছে নিবে সম্মানের একটা জীবন? 
যে জীবনই বেছে নিক না কেন। আমার তাতে কী? চুলোয় যাক আবিরের জীবন। ওর কথা চিন্তা করে আবারো কেন অকারন মায়া বাড়ানো। এই মায়াজাল যে বড়ই লজ্জার, বড়ই অসম্মানের।

(সমাপ্তি)



একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ